Sunday, August 28, 2016

একটি সরকারি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত রাজু শেখ (১৩, ছদ্মনাম) পারিবারিক কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার একদিন সে শোনে স্কুল থেকে তাকে কেউ ডাকছে দৌড়ে স্কুলে যায় সে দেখতে পায় স্কুলের বেঞ্চে বসে তিন-চারজন বন্ধু কথা বলছে, ভেঙচি কাটছে কিন্তু স্কুলের দারোয়ান জানায়, সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল রাজু একা একাই যেন স্কুলে এসে কাদের সঙ্গে কথা বলছিল




কদিন ধরে রাজুর বাবা-মাও তার মধ্যে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ দেখতে পান এরপর তাঁরা রাজুকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান চিকিৎসক জানান, তার সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে

মিলন রহমান (২২, ছদ্মনাম) কয়েক দিন ধরে মানসিক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি মনে করেন তাঁর মধ্যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে তাঁর মধ্যে এমন জ্ঞান রয়েছে, যা বিশ্বের মানুষ ব্যবহার করলে সবাই শান্তিতে থাকবেকিন্তু কেউ তাঁর যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছে না সবাই তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে তাঁর ধারণা, তিনি সব সময় ঠিক বলছেন পরিবারের লোকজন তাঁকে ভুল বুঝছে কিন্তু মনোচিকিৎসক জানান, মিলন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত

সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ রোগের  লক্ষণ হচ্ছে চিন্তাধারা (প্রত্যক্ষণ, চিন্তন) এবং অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি না থাকা সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দমূল Skhizein (to Split বা বিভক্ত করা) এবং phrenos (mind বা মন) থেকে বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির ওয়েবসাইটে রোগ সম্বন্ধে মনোবিজ্ঞানী হোসনে আরা বেগম বলেন, রোগাক্রান্তের পরিবার এবং পরিচিতরা সমস্যায় পড়ে যান রোগীর অদ্ভুত আচরণ দেখে তাদের সাথে মানিয়ে চলাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এই রোগকে অনেক সময় মানসিক রোগের ক্যানসার হিসেবেও উল্লেখ করা হয় চলুন আরো কিছু তথ্য জেনে নিই এই রোগটি সম্পর্কে

শুরুর কথা

১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিদ এমিল ক্রেপলিন প্রথম এই রোগের সন্ধান পান এই রোগ মূলত চেতনাকে আক্রান্ত করে বলে ধারণা করা হয় এটি একই সাথে আচরণ এবং আবেগগত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে ১৯১১ সালে ইউগেন ব্লুলেয়ার প্রথম সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার জানান, বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ
স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট সিজোফ্রেনিয়া ডটকমের তথ্য মতে, চীনে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ থেকে এক কোটি ২০ লাখ ভারতে এই রোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৮০ লাখ ৭০ হাজার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি সিজোফ্রেনিয়া এতে আক্রান্তরা সম্মানহীন, বন্ধুহীন, আত্মীয়হীন অবস্থায় জীবনযাপন করে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে


লক্ষণ

মনোবিশেষজ্ঞ তুষার জানান, ভ্রান্ত বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা (ডিল্যুশন), অবাস্তব চিন্তাভাবনা, হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ), অসংলগ্ন কথাবার্তা ইত্যাদি সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষণ হচ্ছে অনাগ্রহ, চিন্তার অক্ষমতা, আবেগহীনতা, বিচ্ছিন্নতা
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এমন ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যার কোনো ভিত্তি নেই যেমন, অনেকে বিশ্বাস করেন তিনি মহাপুরুষ তাঁর অনেক ক্ষমতা আছে যা দিয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায় 

কোনো কারণ ছাড়াই কেউ বিশ্বাস করে তাঁর নিজের বাবা-মা, স্বামী স্ত্রী বা কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর ক্ষতির চেষ্টা করছে তাঁকে পাগল বানাতে চেষ্টা করছে বা হত্যা করতে চাইছে রোগী নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারেন রোগীর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসসংক্রান্ত কতগুলো ভুল ধারণার জন্ম নেয় তিনি নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন কেউ স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি তীব্র সন্দেহে ভুগতে পারেন

রোগী কতগুলো অবাস্তব দৃশ্য দেখে, এগুলোকে বাস্তব মনে করেন কোনো বাস্তব স্পর্শ ছাড়াই অনুভব করতে পারেন, কেউ তাকে স্পর্শ করছে শরীরে খোঁচা লাগার অনুভূতিও হতে পারে তাঁরা অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলেন বা কথা ঠিকমতো বোঝা যায় না

এই রোগীদের আচরণ স্বাভাবিক থাকে না কখনো একেবারে চুপচাপ, আবার কখনো অতিরিক্ত নড়াচড়া করেন বা কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন পোশাক-আশাক এবং নিজেরাও অপরিষ্কার থাকেন কোনো কাজেই উৎসাহ পান না
অনেকে অন্য কারো সাথে, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারেন না  একা একা থাকতে চান

কী কারণে হয়

মনোবিজ্ঞানী তুষার বলেন, সিজোফ্রেনিয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি তবে বিভিন্ন কারণে সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক কারণ বেশি কাজ করতে পারে আবার কতগুলো কারণ একসাথেও কাজ করতে পারে বংশে কারো থাকলে রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি বাবা মা দুজনের মধ্যে একজনের থাকলে সন্তানের রোগ হওয়ার আশঙ্কা ১৭ শতাংশ 

যদি উভয়েরই থাকে তবে সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৪৬ শতাংশ গবেষণায় দেখা যায়, মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণে ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদান ভারসাম্যহীন হলে রোগ হয় জন্মকালীন কোনো জটিলতা থাকলেও রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে

বঞ্চিত পরিবারে সিজোফ্রেনিয়া বেশি দেখা যায় গর্ভকালীন মা ইনফ্লুয়েঞ্জা বা রুবেলা আক্রান্ত হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায় অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করার প্রবণতা তৈরি হয়

যুক্তরাষ্ট্র্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, সিজোফ্রেনিয়া রোগটি একক কোনো রোগ নয় বরং আটটি ভিন্ন ধরনের সমস্যার সমন্বিত রূপ তাঁদের মতে, এই নতুন ধরনের ব্যাখ্যায় রোগটি ব্যাখ্যার নতুন দুয়ার খুলে গেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড্রাগান সভ্রাকিক বলেন, জিনগুলো আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না বরং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটায় ফলে সিজোফ্রেনিয়া হয়

রোগ কীভাবে নির্ণয় করা হয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ অতীত কর্মকাণ্ড পযর্বেক্ষণের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়

চিকিৎসা

গবেষণায় দেখা গেছে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, ৫০ ভাগ ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে বাকি ২৫ ভাগ কখনোই ভালো হয় না এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হচ্ছে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কারণ নিয়মিত ওষুধ কতগুলো মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ এবং উপদেশ মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়

সিজোফ্রেনিয়ায় দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে : ওষুধ প্রয়োগ সাইকোথেরাপি এক্ষেত্রে ইনডিভিজুয়াল সাইকোথেরাপির মধ্যে রয়েছে হ্যালুসিনেশন নিয়ন্ত্রণ, ফ্যামিলি থেরাপি, যোগাযোগের প্রশিক্ষণ, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ইত্যাদি 

অনেক সময় ভালো হয়ে যাওয়ার পর ওষুধ বন্ধ করে দিলে পুনরায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি 
সিজোফ্রেনিয়া নিয়েও একজন রোগী ভালোভাবে বাঁচতে পারে, যদি ঠিকমতো চিকিৎসা করা যায় এক্ষেত্রে পরিবার সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

মনোবিজ্ঞানী তুষার বলেন, যেসব পরিবার তীব্র আবেগ প্রকাশ করে, তাদের সদস্যদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি রোগীকে মানসিক চাপ না দেওয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা চিন্তামুক্ত রাখা খুব জরুরি যদি তিনি ওষুধ সেবনের মধ্যে থাকেন তবে ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না খেয়াল রাখতে হবে সামাজিকভাবে রোগীর ক্ষেত্রে সহেযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তাকে পাগল বিবেচনা করা ঠিক নয় এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মোহাম্মদ জহির উদ্দিন বলেন, সিজোফ্রেনিয়াকে একসময় বলা হতো সাইকিয়াট্রির ক্যানসার বলা হতো এটি ভালো হয় না এমন বিশ্বাস এখনো প্রচলিত বাংলাদেশে সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসা খুব ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে না যতটুকু আছে তা শুধু ওষুধ প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাও ঠিকমতো হচ্ছে না 

এখনো কবিরাজ, ফকির, ওঁঝাদের খপ্পর থেকে এই চিকিৎসা পুরোপুরি ডাক্তারদের হাতে আসেনি আবার অনেকে বোঝেনই না যে এটি রোগ অনেকে জানেন না কোথায় চিকিৎসা পাওয়া যায় যারা জানেন তারাও ভুলভাবে জানেন ভাবেন ওষুধ খেলে মানুষ আরো পাগল হয়ে যায় ফলে সিজোফ্রেনিক রোগীকে সাংঘাতিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তাঁরা মার খান, নির্যাতিত হন, বিনা চিকিৎসায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়

জহির উদ্দিনের মতে, সিজোফ্রেনিয়া রোগীর চিকিৎসা সফল হতে হলে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগটিকে শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে হবে ছাড়া সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন রোগীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
সেবা পাবেন যেখানে

 তথ্যসূত্র - ntvbd

এর চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা; মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকাআর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগ পাবনা মানসিক হাসপাতালে

0 comments:

Post a Comment

Healthymoy. Powered by Blogger.

''Good Health Good Life''


অতি প্রয়োজনীয়

Popular Posts